ফ্রিল্যান্সিং জিনিসটা আসলে আমাদের একেকজনের কাছে একেক রকম । প্রফেশনালি আমি প্রায় আট বছর ধরে ফ্রিল্যান্সিং করি, যা কিছু করেছি নিজে নিজে শিখে করেছি । জীবনে কোথাও ট্রেনিং নেইনি, এ কারণে ভুলের সংখ্যাটা বোধহয় অনেক বেশি ছিল, আমার ভুলগুলো থেকে আমি শেখার ট্রাই করেছি । পার্সোনাল ফ্রিল্যান্সিংকে আলহামদুলিল্লাহ আমি একটা বিজনেসে দাঁড় করাতে পেরেছি । আপনাদের সবার মাঝেও এই টার্গেট টা থাকা উচিত । ইনশাআল্লাহ একটা লম্বা পথ সফলতার সাথে পাড়ি দিতে পারবো (দোয়া করবেন) এটাই সব সময় প্রার্থনা করি । ব্যক্তিগত একটা প্যারাগ্রাফ বলার কারণ হচ্ছে, ফ্রিল্যান্সিং জিনিসটা যেহেতু আমাদের দেশে অনেক জনপ্রিয়, স্বাভাবিকভাবেই এটা নিয়ে অনেকের মাঝে অনেক ধরনের ভুল ধারণা আছে, পজিটিভ ভুল ধারণা যেমন আছে, আবার অনেক নেগেটিভ রকমের ভুল ধারণাও আছে । আজকে আমি ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে আমাদের মাঝে সবচেয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারনা নিয়ে কথা বলব ।
#১ – ফ্রিল্যান্সিং খুব সহজ
বিশেষ করে নতুন যারা বা অনেকেই আমাদের মাঝে আছেন যারা অন্যের ইনকাম দেখে (অনেক সময় লোভের বশবর্তী হয়ে) ফ্রিল্যান্সিং এ আগ্রহী, তাদের ধারণা এটি খুবই সহজ একটা ব্যবসা! । জাস্ট মোবাইল দিয়ে বা কম্পিউটার কিনে বসে যাবেন এবং লাখ লাখ টাকা ইনকাম করা শুরু করবেন । আপনি যদি এমন একটা ধারণা নিয়ে বসে থাকেন তবে আমি বলবো, এটা এই মুহূর্তেই বাদ দেন । পৃথিবীতে সহজ ব্যবসা বা পেশা বলে কিছু নাই । প্রত্যেকটা ব্যবসা আপনাকে কঠিন পরিশ্রম করে, সঠিক স্ট্র্যাটেজি ফলো করে দাঁড় করাতে হয় এবং এর পরও অনেক ব্যবসা টিকে থাকে না । ফ্রিল্যান্সিং এর থেকে আলাদা কিছু না । হ্যাঁ, এখানে কাজের পরিমাণ প্রচুর কিন্তু আপনার মত লাখ লাখ ছেলে মেয়ে সে কাজটা করার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে, যাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো আপনার থেকে দক্ষ । এখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং ভালো একটা ইনকাম করা (আমি আপনাকে হতাশ করতে চাই না) এটা অনেক কঠিন একটা বিষয় । তবে যদি আপনার দক্ষতা থাকে, প্যাশন থাকে এবং সঠিক পথে লেগে থাকেন, আশা করা যায় এটা আপনি জয় করতে পারবেন । কখনোই ভাববেন না, ফ্রিল্যান্সিং খুবই সহজ! তাহলে আপনি টিকতে পারবেন না ।
#২ – ফ্রিল্যান্সিং দুইদিনের ব্যবসা!!
প্রায় বেশিরভাগ মানুষই ভেবে থাকেন, ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে দুই দিনের ব্যবসা! এটা যেকোনো সময় চলে যেতে পারে!! । আমি বলব, এটা নির্ভর করবে আপনি আসলে কি ধরনের ফ্রিল্যান্সার, কি ধরনের কাজ করেন তার উপর । অনেক ধরনের চাকরী আছে যেখানে আপনারে ৫ মিনিটের নোটিশে fired করতে পারে! । আমি কিছু ফ্রিল্যান্সারকে চিনি যারা আপওয়ার্ক বা ফাইভারে ১০ বছরের ওপরে থেকে কাজ করছে এবং খুব সফল ভাবে জীবন যাপন করতেছে । আবার আমি অনেককে চিনি, তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সবকিছু হারিয়ে বসে আছেন । এর কারণ হচ্ছে, অনলাইনের সব কাজই তো ফ্রিল্যান্সিং, তবে সব কাজ কিন্তু বৈধ না । আপনার আশেপাশে এমন অনেকে আছে যারা ধরেন যে, খেলার চ্যানেল গুলো সাবস্ক্রিপশন বা অ্যাফিলিয়েট এর মাধ্যমে অবৈধভাবে স্ট্রিমিং করে, এটা কিন্তু বেশিদিন টিকবে না কারণ এটা অবৈধ । যেটা বিষয় হচ্ছে, যদি আপনি বৈধভাবে কোন মার্কেটপ্লেসে তাদের রুলস এন্ড রেগুলেশন মেনে কাজ করেন, তাহলে আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই । অবশ্যই মার্কেটপ্লেসে কাজ করার মধ্যে কিছু লিমিটেশন আছে । এ কারণে আমি বলব যে, আপনি মার্কেটপ্লেসে কাজ করার সাথে সাথে যদি নিজস্ব একটা বিজনেস দাঁড় করাতে পারেন বা একটা এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, এর থেকে বেটার কিছু আপনার লাইফে হইতে পারে না । চাকরিতে যেটা হয় যে, আপনি একটা কোম্পানির হয়ে কাজ করেন, তারা কিন্তু আপনাকে যেকোন সময় চাকরি থেকে বাদ দিতে পারে তখন কিন্তু আপনার টোটালি নতুন একটা জব খুজতে হবে কারণ আপনার ইনকাম সোর্স ১০০% বন্ধ হয়ে যাবে । ফ্রিল্যান্সিংয়ে আপনি যদি অনেকগুলো ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করেন, একটি ক্লায়েন্ট চলে গেলেও আপনার ইনকাম সোর্স কিন্তু হান্ডেট পার্সেন্ট বন্ধ হবে না । নতুন একটা ক্লায়েন্ট খুঁজে বের করা খুব কঠিন কিছু না, তবে নতুন একটা জব পাওয়া কিন্তু অনেক কঠিন বিষয় । আরেকটা বিষয় হচ্ছে, অনেক কোম্পানি কিন্তু নতুনদের হায়ার না করে ফ্রিল্যান্সিং এর দিকে ঝুঁকে পড়ছে । বড় বড় কোম্পানি তাদের অনেক কাজ আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে করিয়ে নেয় এখন । যদি আপনি একটা প্রপার বিজনেস মডেল দাঁড় করাতে পারেন, ইনশাআল্লাহ আপনি ৩০ বছরের বেশি সময় আপনার বিজনেস চালাতে পারবেন এবং স্টেডি একটা ইনকাম সব সময় আসবে বলে আমার ধারণা ।
#৩ – নরমাল চাকরির থেকে ফ্রিলেন্সিং এ চাপ অনেক বেশি
ওকে, এটাও একটা নির্ভরশীল বিষয় । শুরুর দিকে আপনার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার যখন গড়ে তুলবেন অর্থাৎ আপনার যখন ফাউন্ডেশন টাইম, তখন আপনাকে প্রচুর চাপ নিতে হবে । নতুন নতুন ক্লায়েন্ট খুঁজে বের করাটা অনেক কঠিন একটা বিষয়, আবার আপওয়ার্ক এর মত প্লাটফর্মে আপনাকে প্রত্যেকদিনই প্রজেক্ট এর পেছনে বিড দিতে হবে । যখন ভালো একটা পজিশনে দাঁড়াইয়া যাবেন, চাপটা আপনা আপনি অনেক কমে যাবে । যদি আপনার এক হাজারের মতো ভালো ফিডব্যাক থাকে (কথার কথা) তাহলে আপনাকে ক্লায়েন্ট খুঁজে বের করতে হবে না, ক্লায়েন্ট ই আপনাকে খুঁজে নেবে । অর্থনৈতিক একটা বিষয় আছে, শুরুর দিকে ইনকাম টা অনেক কম হবে । আপনার মনে হতে পারে, এত এত কাজ করছি, টাকা তো সেভাবে পাচ্ছি না! । এটা জেনে রাখেন, ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আপনার প্রজেক্ট প্রাইস গুলো অন্যদের থেকে তুলনামূলক কম রাখতে হবে, এতে আপনার কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি । তবে সাথে এটাও মনে রাখবেন, আমি আবার অন্য blog বলেছি – প্রাইস টা অস্বাভাবিক ভাবে কম রাখবেন না, বাস্তবতার নিরিখে রাখবেন । সময়ের সাথে সাথে আপনি যখন আরো কিছু লোক নিতে পারবেন, চাপটা অনেক কমে যাবে । আপনি রিলাক্সে বিজনেস চালাতে পারবেন । তবে যদি টিকে থাকতে চান, পৃথিবীর কোন ব্যবসায় আলসেমির সুযোগ নাই ।
#৪ – আপনিই আপনার বস
ফ্রিল্যান্সিংয়ে আপনার কোন বস নাই! এটা আসলে একটা ভুল ধারণা । পৃথিবীতে বস নাই বলে কোন বস্তু নাই । আমরা সবাই বড় একটা শিকলে বন্দী, এটাকে বলে, চেইন অফ কমান্ড । উদাহরণ দেই, বিষয়টা সহজ হবে – আপনি আপনার ছোট বোনকে বকা দেন, আপনাকে আপনার মা বকা দেয়, আপনার মা কে আপনার আব্বা হয়তো শাসন করে আর আপনার বাবারে আপনার দাদা সাইজ করে । তবে হ্যাঁ, নর্মাল চাকরির মত এইখানে আপনার কোন বস নাই, তবে ‘কাছাকাছি লেভেলের’ বস আছে । সত্যি বলতে, আপনারা আসলে দুইটা বস – আপনার ক্লায়েন্ট এবং আপনি নিজেই ।
এখানে যেটা সুবিধা হচ্ছে, আপনার ক্লায়েন্ট যেমন আপনাকে প্রজেক্ট থেকে বাদ দিতে পারে, আপনিও কোন ক্লায়েন্ট কে পছন্দ না হলে তারে ‘fired’ করতে পারেন! । তবে হ্যা, traditional বসদের যে ঝামেলা এর ৯০% এখানে নাই । দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা যতো বাড়বে, আপনি ততো সহজেই ক্লায়েন্ট ম্যানেজ করতে পারবেন ।
#৫ – এটা সত্যিকারে কোন ব্যবসা না
অন্য যে কোন ব্যবসার মতো ফ্রিল্যান্সিং একটা স্ট্যাবল, ফ্যামিলি চালানোর মত সত্যিকারের ব্যবসা । তবে, আপনি যদি সারাজীবন মার্কেটপ্লেসে কাজ করার ইচ্ছা করেন, সেই সেন্সে এটা হয়তো ওই টাইপের বিজনেস হবে না । আমার মতে, যত দ্রুত সম্ভব নিজস্ব একটা বিজনেস বা এজেন্সি দাঁড় করানো উচিত । ওইটা কিন্তু সত্যিকারের বিজনেস হবে, যেখানে আপনার স্বাধীনতাটা মার্কেটপ্লেসের থেকে অনেক বেশি, আপনি সত্যিই আপনার বস, তবে আপনার ক্লায়েন্টের সাথে দায়বদ্ধতা সব সময় থাকবে । ফ্রিল্যান্সিংয়ের যেটা সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, আমাদের যে সামাজিক অবস্থা (আপনি কি করতে চান মনের দিক থেকে, পরিবার এটা কখনো বুঝতে চায় না, সবাই দুইটা পেশা চিনে, ওটা নিয়েই হাউকাউ করে!) এখানে ফ্রীল্যান্সিং এর কথা বললে তারা ভাবে, এটা টেম্পোরারি একটা জিনিস, এর কোনো বৈধতা নাই, যেকোনো সময় আপনার আয় এর পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে । একারণেই যখন আপনি তাদের বলবেন, আপনি শুধু ফ্রিল্যান্সিং করেন না , সাথে আপনার একটা পার্সোনাল বিজনেস আছে; তখন বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে যায় ।
- ভাই আপনি কি করেন?
- বিজনেস করি ভাই
- কি বিজনেস করেন?
- অনলাইন বিজনেস
আমি, বোঝে না এই টাইপের মানুষের সাথে কখনো যদি পরিচয় দিতে হয়, তখন এই দুইটা লাইন সবসময় ব্যবহার করি । ঝামেলা কম ।
সবাই ভালো থাকবেন ।